১৯৩৫ সালের ৮ মে বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নানা বাড়ি মাগুরা জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার মা আছিয়া খাতুন এবং বাবা সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ। বাবার বাড়ি ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়। কলকাতার বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং প্রাচ্যের অক্্রফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। স্বামী জনাব মরহুম গোলাম আকবর চৌধুরী ছিলেন ভাষাসৈনিক, চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী। তার তিন ছেলে এবং এক কন্যা।
১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীগি ময়দানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে প্রথম নারী নেত্রী হিসেবে সাজেদা চৌধুরী তেজোদীপ্ত বক্তব্য দেন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
নারী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা থাকায় ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সাতজন মহিলা এমএনএর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা চৌধুরী। গোবরা নার্সিং ক্যাম্পে পরিচালক হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন তিনি, যা আমাদের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতাত্তোর নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার উপর। তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গালর্স গাইডের ন্যাশনাল কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হওয়ায় বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় স্বৈরাশাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব এবং ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে টেকনোকর্যাট কোটায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ফরিদপুর (ফরিদপুর-২ নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে সাজেদা চৌধুরী কতটা সহনশীল ছিলেন, তা তার কাজে মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ফরিদপুরের তার আসনে সব সময় সাজেদা চৌধুরী তুখোড় প্রতিদ্বন্ধী থাকতেন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব ওবায়দুর রহমান সাথে।
২০০৭ সালে ওবায়দুর রহমান মারা গেলে সেখানে তার প্রতিদ্বন্ধী হয়ে ওঠেন তার মেয়ে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি শামা ওবায়েদ ইসলাম। ওই বছরই শামা ওবায়েদ বিএনপির মনোনয়নে প্রথমবার কোনো জাতীয় নির্বাচনের অংশ নেন। সেবার শামা ওবায়েদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে ২০০৯ সালে সরকার তাকে সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ফরিদপুর- ২ আসন থেকে সপ্তম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তৃতীয়বারের মতো সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাণ, দুঃসময়ের কা-ারি, সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের ‘ফুফু’খ্যাত সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য কিংবদন্তি নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দেশ ও দেশের জনগণের সেবায় নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদে উপস্থিতি ছাড়াও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল সভায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পাশেই থেকেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। স্বাধীনতার অগ্নিকন্যা প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।